নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাসের এক বছর পূর্ণ হলো বৃহস্পতিবার ৭ ফেব্রুয়ারি। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাবন্দী হন তিনি। দলীয় প্রধানের মুক্তির জন্য আইনি পথে হাঁটছে বিএনপি। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। আর খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাজপথের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে না। আইনি ও আন্দোলন—দুটো পথ বেছে নেওয়া হলেও কোনোটি থেকে এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি বিএনপি।
এর মধ্যে খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির ভরাডুবির পর দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক এমনকি সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন বিএনপি তাহলে কী করবে। কারাগারে থেকেই খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্ব দেবেন না কি তাঁর মুক্তির জন্য বিএনপি কঠোর আন্দোলনে যাবে। দলের মধ্যে এমন আলোচনাও আছে সরকার না চাইলে খালেদা জিয়ার মুক্তি কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে বিএনপি কি খালেদা জিয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করবে। আর সেটা চাইলে কী দিয়ে হবে সেই সমঝোতা?
বিএনপির অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতা একমত যে, আইনি পথে খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব না। তাঁরা সে কথা প্রকাশ্যে বলেছেনও। এ প্রসঙ্গে আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, সরকার চাইলেই কেবল খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব। বিএনপির অপর একজন আইনজীবী বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করতে থাকলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ‘অসম্ভব’। এ জন্য আগে সরকারকে ‘ম্যানেজ’ করতে হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছরের আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে ৭ বছরের জেল দিয়েছেন আদালত।
খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলের স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ নেতারা আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান করছিলেন। আর নিজের ‘সুবিধা’ বিবেচনা করে নয়াপল্টন কার্যালয়ে অবস্থান করা দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রায় ঘোষণা হওয়ার পর রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলন করেন। যেখানে তিনি যথারীতি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন এবং খালেদা জিয়ার জন্য নিজের আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন। পরে ওই বছরের ৩০ অক্টোবর খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা রিভিশন আবেদনের রুল যথাযথ ঘোষণা করে হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে দেন।
দলের চেয়ারপারসন দুর্নীতির মামলায় সাজা পেয়ে কারাগারে, সেখানে বিএনপি বড় ধরনের কোনো জনমত তৈরি করতে পারেনি। তাদের দাবির প্রতি সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। বিএনপি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। মহানগর, ওয়ার্ড, বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় মিলিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীর অভাব নেই। কিন্তু খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়ার দিন দলের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের (বর্তমানে কারাবন্দী) নেতৃত্বে মগবাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল ছাড়া সারা দেশের কোথাও একটি বিক্ষোভ মিছিল করতে পারেনি দলটি।
আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেখতে চেয়েছিল খালেদা জিয়াকে কারাবন্দী করলে বিএনপির প্রতিক্রিয়া কী হয়? কিন্তু দেশে-বিদেশে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় আওয়ামী লীগ অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসে। এ কারণে এরপর বিএনপি যে দাবিই করেছে, আওয়ামী লীগ তা অস্বীকার করেছে। নিজেদের সুবিধা মতো এবং পরিকল্পনা মতো আওয়ামী লীগ যা যা করতে চেয়েছে, সবই করতে পেরেছে। বিএনপির সংবাদ সম্মেলন নির্ভর প্রতিবাদ আওয়ামী লীগের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারেনি।
নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের আন্দোলনের সময় সহিংসতা করে দেশব্যাপী সমালোচিত হয় বিএনপি। এরপর দলটি আন্দোলনের প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে। যে কারণে সহিংসতা, অবরোধ ও হরতালে দেখা যায়নি দলটিকে। এ ছাড়া খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে আহ্বান জানান। এই বিষয়টিকে সামনে এনে বিএনপি বোঝানোর চেষ্টা করেছে, তারা কোনো সহিংসতা করতে চায় না।
বিএনপির যেকোনো কর্মসূচি ঘিরে বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন, বিএনপির কর্মসূচি থেকে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার এবং বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে দলটির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে সরকার। গায়েবি মামলা, বিএনপির নেতাদের বাড়ি থেকে বের হতে না দেওয়া, ধরপাকড়, নির্যাতন ধীরে ধীরে দলটিকে পেছনে নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়ানোর মতো কোনো পরিস্থিতি দলটি সামনে আনতে পারেনি। রাজপথে খালেদা জিয়ার না থাকার অভাবটা এখন বিএনপি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির নেতারা প্রতীকী অনশন, মানববন্ধন, সেমিনার, বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করতে বৈঠক করা ছাড়া রাজপথে কোনো আন্দোলন করতে পারেননি। কিংবা একটি বিক্ষোভ মিছিল করে সরকারের মনোভাব বোঝারও চেষ্টা করেননি তাঁরা। কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ না হলে মামলা হবে এমন চিন্তা দলটিকে রাজপথ থেকে দলীয় কার্যালয়ে আবদ্ধ করে ফেলেছে।
এ ছাড়া বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে প্রথম শর্তে স্থান পেয়েছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। আর নির্বাচনের কথা বলতে গিয়ে তখন এসেছে ‘খালেদা জিয়াবিহীন নির্বাচন এ দেশে হতে দেওয়া হবে না’। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন যে একটি বড় ইস্যু হতে পারে, সে বিষয়টিতে মনযোগ দেননি বিএনপির নেতারা। খালেদা জিয়াকে ছাড়া যে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হলো, সেখানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিএনপির অর্জন মোটে আটটি আসন। সেখানে বিএনপির বিরুদ্ধে মনোনয়ন ‘বাণিজ্যের’ মতো গুরুতর অভিযোগ তো আছেই। দেশের অন্যতম একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি, যে দলটির সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য, কোনো বিষয় হিসেব রাখার জন্য, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড এবং সর্বোপরি রাজনীতির হাওয়া কোন দিকে যাচ্ছে—এসব বিষয়ে সমন্বয় করার বা নজর রাখার কোনো সেল নেই। একই বিষয়ে দলের একেক নেতার একেক বক্তব্য দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ।
বিএনপির মাঠের এবং কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়া জেলে না থাকলে নির্বাচন নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা উঠত না। দলের মধ্যে অনৈক্য তৈরি হতো না। এর মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে বিএনপি যদি জাতীয় সংসদে যোগ দেয়, তাহলে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে! এমন সমঝোতার কথা উঠেছে দলের মধ্যে। যদিও এর কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান মনে করেন, স্বার্থান্বেষী মহল এ ধরনের কথা রটাচ্ছে।
অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তারা সংসদে যাচ্ছেন না। বিএনপির মাঠের নেতারা বলছেন, বিএনপির উচিত খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ খালেদা জিয়াহীন বিএনপি কেমন হতে পারে, তা এই মুহূর্তে সহজে অনুমান করা যাচ্ছে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য যেসব আইনজীবী কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রবীণ ও বিখ্যাত আইনজীবীও আছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে তাঁরাও সরকারের ‘অনিচ্ছা’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘কূটকৌশল’—এসবের অভিযোগ এনেছেন এবং চেষ্টার জায়গায় ত্রুটি রেখেছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় ১৯ মার্চ ২০১৪ সালে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে অভিযোগ গঠনের সময় আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার একটি বিধান আছে। এ জন্য আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে আবেদন করতে হয়। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আবেদন করেননি।
তা ছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সম্ভাব্য যত আইনি পথ আছে, সেখানে দলটির আইনজীবীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় তাঁর লিখিত বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক, বিভিন্ন মামলায় আগেই খালেদা জিয়ার জামিন না নেওয়ার বিষয়টি কতটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
No comments:
Post a Comment